শেখ হাসিনার বিচার: মৃত্যুদণ্ডের ছায়ায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ
অভিযোগের মূলে: কোটা আন্দোলন থেকে রক্তাক্ত দমন
গত বছরের জুলাই মাসে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন দ্রুতই শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে রূপ নেয়। এই আন্দোলনকে দমন করতে নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগে শেখ হাসিনাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, এই অভিযানে ১,৪০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যার মধ্যে শত শত শিশু এবং নারী ছিলেন। বিশেষ করে ৫ আগস্ট তারিখটি ছিল সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী—যেদিন শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে ভারতে পালিয়ে যান এবং ঢাকার রাজধানীতে জনতা তার বাসভবনে হামলা চালায়। সেদিন পুলিশের গুলিতে অন্তত ৫২ জন নিহত হন, যা বিবিসির তদন্তে বাংলাদেশের ইতিহাসে পুলিশি সহিংসতার সবচেয়ে খারাপ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
অভিযোগের আরও গুরুতর অংশ হলো নিহতদের মরদেহ পোড়ানোর নির্দেশ এবং আহতদের চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা। সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন গ্রেফতার হয়ে আদালতে স্বীকার করেছেন যে, হেলিকপ্টার, ড্রোন এবং প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার তার নির্দেশেই হয়েছে। এছাড়া, সরকারপক্ষের কাছে ফোন রেকর্ড, অডিও-ভিডিও প্রমাণ রয়েছে, যা শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশ প্রমাণ করে। একটি লিক হয়ে যাওয়া অডিও টেপে তাকে বলতে শোনা গেছে, “যেখানেই পাবে, গুলি করো”।
সাক্ষ্য এবং দাবি: মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে-বিপক্ষে
ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আদালতে বলেছেন, “শেখ হাসিনা ১,৪০০ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। তিনি ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার জন্য নিষ্ঠুর অপরাধী হয়ে উঠেছেন এবং তার কোনো অনুশোচনা নেই।” রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ময়নুল করিম যোগ করেছেন, “আমাদের প্রমাণগুলো স্পষ্টভাবে তার প্রত্যক্ষ নির্দেশ প্রমাণ করে। সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই উচিত।” বিচারটি ১ জুন শুরু হয়েছে এবং পাঁচটি অভিযোগ (হত্যা প্রতিরোধে ব্যর্থতা সহ) মানবতাবিরোধী অপরাধের আওতায় পড়ে।
অন্যদিকে, শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মোহাম্মদ আমির হোসেন যুক্তি দিয়েছেন যে, নিরাপত্তা বাহিনী আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়েছে, কারণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। তিনি বলেছেন, “হাসিনা দেশ ছাড়তে চাননি; তাকে বাধ্য করা হয়েছে।” শেখ হাসিনা নিজে বিচারকে “কাঙ্গারু কোর্ট” বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং কোনো আইনজীবী নিযুক্ত করেননি। তার ভাগনি এবং যুক্তরাজ্যের লেবার এমপি টিউলিপ সিদ্ধিক এই বিচারকে “সাজানো প্রহসন” বলে অভিহিত করেছেন, যিনি নিজেও দুর্নীতির অভিযোগে আসামি।
সাম্প্রতিক আপডেট: ১৬ অক্টোবর প্রসিকিউটররা আবারও মৃত্যুদণ্ড দাবি করেছেন, এবং ২৩ অক্টোবর আদালত ঘোষণা করেছে যে, চূড়ান্ত রায় ১৩ নভেম্বর ঘোষিত হবে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও একই শাস্তির দাবি করা হয়েছে।
বিশ্লেষণ: রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নাকি ন্যায়বিচার?
এই বিচারটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গভীর বিভাজনের প্রতিফলন। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনকালে অর্থনৈতিক উন্নয়ন (জিডিপি গ্রোথ ৬-৭%) সত্ত্বেও, বিরোধীদের দমন, প্রেস স্বাধীনতার উপর নিয়ন্ত্রণ এবং অপোজিশন নেতাদের হত্যার অভিযোগ তাকে বিতর্কিত করেছে। এই আন্দোলনটি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা হিসেবে চিহ্নিত, যা তার পতন ঘটায়।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই বিচারটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের (নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে) রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অংশ হতে পারে। আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়নি, ফলে বিএনপি এগিয়ে রয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন এই বিচারের ফলাফলের উপর নির্ভর করবে। আন্তর্জাতিকভাবে, এটি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে পারে, যেহেতু হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিচারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, যখন আওয়ামী লীগের নেতারা এটিকে “ফ্যাসিস্ট ইউনুসের চক্রান্ত” বলে অভিহিত করছেন।
এছাড়া, শেখ হাসিনার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ক্ষতিপ্রাপ্তদের মধ্যে বণ্টনের প্রস্তাব উঠেছে। তিনি ইতিমধ্যে আদালত অবমাননায় ৬ মাসের কারাদণ্ড পেয়েছেন এবং দুর্নীতির মামলায় আসামি। তার পরিবারের সদস্যরা, যেমন মেয়ে সাইমা ওয়াজেদ (জাতিসংঘের কর্মকর্তা),ও অভিযুক্ত।
উপসংহার: ন্যায়ের আশা কি রাজনৈতিক খেলা?
শেখ হাসিনার বিচার বাংলাদেশকে একটি ক্রসরোডে নিয়ে এসেছে—যেখানে ন্যায়বিচার এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সীমা অস্পষ্ট। ১৩ নভেম্বরের রায় যদি মৃত্যুদণ্ড হয়, তাহলে এটি দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করবে। কিন্তু যদি এটি রাজনৈতিক স্বার্থের খেলা হয়, তাহলে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা বিপন্ন হবে। এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ক্ষমতার অপব্যবহারের মূল্য কখনো সস্তা হয় না। আরও আপডেটের জন্য নজর রাখুন।
**সূত্র: দৈনিক নয়া দিগন্ত, বিবিসি, ওয়াশিংটন পোস্ট, ইন্ডিয়া টিভি, এবং X পোস্ট থেকে সংগৃহীত তথ্য।**
**সম্পাদক: আন্তর্জাতিক ডেস্ক**