পিআর পদ্ধতি : বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কারের আশা নাকি অস্থিরতার ছায়া?
পিআর পদ্ধতি কী? একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (Proportional Representation বা PR) হলো এমন একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা, যেখানে জাতীয় সংসদের আসনগুলো ভোটারদের মোট ভোটের অনুপাতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিতরণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো দল ২০% ভোট পায়, তাহলে তারা সংসদের প্রায় ২০% আসন পাবে। এটি প্রথম-পাস-দ্য-পোস্ট (FPTP) পদ্ধতির বিপরীত, যা বাংলাদেশে বর্তমানে চালু—যেখানে প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকায় সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া প্রার্থীই জয়ী হয়, ফলে ছোট দলগুলো প্রায়শই বাদ পড়ে। বিশ্বে ৯১টি দেশে PR ব্যবহৃত হয়, যেমন জার্মানি, নেদারল্যান্ডস এবং দক্ষিণ আফ্রিকা।
সুবিধাসমূহ: আরও ন্যায়ভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের প্রতিশ্রুতি
PR পদ্ধতির সমর্থকরা এটিকে 'সত্যিকারের গণতন্ত্রের চাবিকাঠি' বলে অভিহিত করেন। প্রধান সুবিধাগুলো হলো:
কম 'অপচয়িত' ভোট: FPTP-তে অনেক ভোট 'অকেজো' হয়ে যায়, কারণ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া প্রার্থীও হেরে যায়। PR-এ প্রায় সব ভোটই কোনো না কোনো আসনে রূপান্তরিত হয়, যা ভোটারদের মধ্যে আস্থা বাড়ায় এবং ভোটার টার্নআউট বৃদ্ধি করে।
বৈচিত্র্যময় প্রতিনিধিত্ব: ছোট দল, সংখ্যালঘু গোষ্ঠী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য সুযোগ বাড়ে। উদাহরণস্বরূপ, নারী, যুবক বা সংখ্যালঘু প্রতিনিধির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, যা বাংলাদেশের মতো বৈচিত্র্যময় সমাজে গুরুত্বপূর্ণ।
কম চাপ-ভিত্তিক রাজনীতি: ভোটাররা 'সবচেয়ে খারাপটাকে বেছে নেওয়ার' ভয় ছাড়াই তাদের পছন্দের দলকে ভোট দিতে পারেন, যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বাড়ায়।
এই সুবিধাগুলো বিশ্বব্যাপী প্রমাণিত—দক্ষিণ আফ্রিকায় PR-এর ফলে ম্যান্ডেলা-যুগের পর সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে।
অসুবিধাসমূহ: অস্থিরতা এবং জটিলতার ঝুঁকি
তবে PR-এর সমালোচকরা এটিকে 'অস্থিরতার উৎস' বলে চিহ্নিত করেন। প্রধান অসুবিধাগুলো:
সরকার গঠনের জটিলতা: কোনো একক দল সাধারণত সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় না, ফলে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। এতে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে পারে, যেমন ইতালিতে PR-এর কারণে ঘন ঘন সরকার পতন ঘটেছে।
লোকাল অ্যাকাউন্টাবিলিটির অভাব: FPTP-এর মতো স্থানীয় এলাকা-ভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব কম, ফলে এমপিরা স্থানীয় সমস্যায় কম দায়বদ্ধ থাকেন।
বিশ্ব পর্যালোচনায় দেখা যায়, PR-এর সাফল্য দেশভেদে ভিন্ন—জার্মানিতে এটি স্থিতিশীলতা দিয়েছে, কিন্তু ইসরায়েলে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: জামায়াতের দাবি vs বিএনপির প্রত্যাখ্যান
বাংলাদেশে PR-এর বিতর্ক ২০২৪-এর শেষভাগ থেকে উত্তপ্ত। জুলাই চার্টারের অধীনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে নির্বাচনী সংস্কারের আলোচনায় PR উঠে এসেছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এই পদ্ধতির জন্য সবচেয়ে সক্রিয়—তারা ৫-দফা দাবিতে PR-ভিত্তিক নির্বাচন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এবং জুলাই চার্টারের বাস্তবায়নের কথা বলছে। ৩০ সেপ্টেম্বর এক প্রেস কনফারেন্সে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরোয়ার ঘোষণা করেন, ১২-দিনের নতুন আন্দোলনের মাধ্যমে PR চাওয়া হবে, কারণ এটি 'প্রতিটি একক ভোটের মূল্যায়ন' করবে। জামায়াতের মতে, FPTP-তে ছোট দলগুলো (যেমন তারা) সিস্টেম থেকে বঞ্চিত হয়। ইসলামী আন্দোলনসহ অন্যান্য ইসলামপন্থী দলও একই দাবিতে রাস্তায় নামছে।
অন্যদিকে, বিএনপি PR-কে সমর্থন করছে না। স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, "পিআর মানে পার্মানেন্ট রেস্টলেসনেস (স্থায়ী অস্থিরতা) সিস্টেম।" সেক্রেটারি জেনারেল মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বলেছেন, "আমরা কখনো PR গ্রহণ করব না।" বিএনপির মতে, এটি দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করবে এবং ফেব্রুয়ারি নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে পারে। এই দ্বন্দ্ব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দ্বিধায় ফেলেছে, কারণ PR চালু করতে সাংবিধানিক সংশোধন দরকার।
বিশ্লেষণ: বাংলাদেশের জন্য উপযোগী কি?
বাংলাদেশের মতো একটি দেশে, যেখানে দুইটি বড় দল (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) দীর্ঘদিন ধরে আধিপত্য বিস্তার করেছে এবং ছোট দলগুলো (যেমন জামায়াত) প্রান্তিক, PR-এর উপযোগিতা মিশ্র। এটি রাজনৈতিক বৈচিত্র্য বাড়াতে পারে, যা ২০২৪-এর ছাত্র-আন্দোলনের পর সংস্কারের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ছোট দলগুলোর উত্থান সংখ্যালঘু ও যুবকদের কণ্ঠস্বর শক্তিশালী করবে, এবং 'ওয়েস্টেড ভোট'-এর সমস্যা কমবে। একটি মিশ্র পদ্ধতি (PR + FPTP) চালু করলে এটি আরও কার্যকর হতে পারে, যেমন নিউজিল্যান্ডে হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, FPTP-এর মতো সরলতা বজায় রেখে কিছু PR উপাদান যোগ করাই বাস্তবসম্মত। সামগ্রিকভাবে, PR বাংলাদেশের জন্য 'আংশিক উপযোগী'—যদি সতর্কতার সাথে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে এটি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে; অন্যথায়, রাজনৈতিক বিভাজন আরও গভীর করবে।
ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের পটভূমিতে এই বিতর্ক কীভাবে সমাধান হয়, তা বাংলাদেশের ভবিষ্যত নির্ধারণ করবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপই একমাত্র পথ—নয়তো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি অনিবার্য।