ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন আজ মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলছে। এই নির্বাচন বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ভবিষ্যৎ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের গ্রহণযোগ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসে উৎসবমুখর পরিবেশ থাকলেও সামাজিক মাধ্যমে অভিযোগ ও বিতর্কের ঝড় চলছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ইসলামী ছাত্র শিবির প্যানেল ভিপি, জিএস এবং এজিএস—এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদে জয়ের সম্ভাবনা দেখাচ্ছে, যা ডাকসু ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হতে পারে।
নির্বাচনের প্রেক্ষাপট
২০১৯ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর এটি প্রথম ডাকসু নির্বাচন, যা অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে এবং ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন অনুসারে, এই নির্বাচন শুধু ছাত্র সংসদের নেতৃত্ব নির্বাচন নয়, বরং বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক সংস্কারের একটি পরীক্ষা। প্রায় ৩৯,৮৭৪ জন ভোটার, যাদের মধ্যে ১৮,৯৫৯ জন মহিলা হল এবং ২০,৯১৫ জন পুরুষ হলের ভোটার, আটটি ভোটকেন্দ্রে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করছেন।
নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল (জেসিডি), গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ইসলামী ছাত্র শিবির এবং স্বতন্ত্র জোটসহ প্রায় দশটি প্যানেল অংশ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক ফেসবুক পোস্ট এবং স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে যে, ইসলামী ছাত্র শিবিরের প্যানেল ভিপি, জিএস এবং এজিএস পদে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে, যা ডাকসুর ইতিহাসে বিরল ঘটনা হতে পারে। তবে, পূর্বের জরিপে উমামা ফাতেমার নেতৃত্বাধীন স্বতন্ত্র জোটের জনপ্রিয়তার দাবি সাম্প্রতিক তথ্যে অস্বীকৃত হয়েছে।
ক্যাম্পাসে উৎসব, সামাজিক মাধ্যমে বিতর্ক
নির্বাচনের প্রচারণা রবিবার মধ্যরাতে শেষ হওয়ার পর ক্যাম্পাসে নীরবতা বিরাজ করছে। তবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উত্তেজনা তুঙ্গে। ফেসবুক পোস্টে শিবির প্যানেলের সমর্থনে উৎসাহমূলক বক্তব্য ও ছবি প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে তাদের ঐতিহাসিক জয়ের সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে। অপরদিকে, শাদিক কায়েমের ফেসবুক পেজে শিবিরের প্রার্থীদের সমর্থনে সক্রিয় প্রচারণা লক্ষ্য করা গেছে। তবে, জাগো নিউজের প্রতিবেদন অনুসারে, শিবির এবং জেসিডি’র কিছু নেতার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট প্রচারণার শেষ দিনগুলোতে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ায় বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ এটিকে প্রযুক্তিগত ত্রুটি বললেও, অনেকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলেছেন।
এক্স প্ল্যাটফর্মে কিছু পোস্টে দাবি করা হয়েছে যে, অমর একুশে হলের ভোটকেন্দ্রে পূর্ব-পূরণকৃত ব্যালট পেপার দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগের সত্যতা স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি, তবে এটি নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
সৃজনশীল প্রচারণা ও শিবিরের উত্থান
এবারের নির্বাচনে প্রচারণায় নতুনত্ব লক্ষ্য করা গেছে। ডেইলি টাইমস অফ বাংলাদেশের প্রতিবেদন অনুসারে, শিবির প্যানেল বাংলাদেশি টাকার নকশায় লিফলেট এবং ইসলামী মূল্যবোধের প্রতীক ব্যবহার করে তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করেছে। তাদের প্রচারণায় জুলাই আন্দোলনের আদর্শ এবং সংস্কারের বার্তা গুরুত্ব পেয়েছে। অন্যদিকে, জেসিডি এবং স্বতন্ত্র জোট হ্যারি পটার থিম এবং প্রজাপতির আকৃতির ফ্লায়ার ব্যবহার করলেও শিবিরের সংগঠিত প্রচারণার কাছে তরুণ ভোটারদের সমর্থনে পিছিয়ে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে।
নির্বাচনের নিরাপত্তা ও প্রস্তুতি
প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. জসিম উদ্দিন জানিয়েছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে, এবং ভোটারদের “ভয়মুক্তভাবে” ভোট দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। তিনি জাল ভোটার বা জাল পরিচয়পত্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তবে, কার্জন হলের দ্বিতীয় তলায় অমর একুশে হলের ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগের প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন তদন্তের আশ্বাস দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক মাধ্যমের দৃষ্টি
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এই নির্বাচনকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রগতির একটি সূচক হিসেবে দেখছে। এমএসএন-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডাকসু নির্বাচন ছাত্র রাজনীতির পুরোনো ভয় ও পৃষ্ঠপোষকতার সংস্কৃতি থেকে মুক্তির প্রয়াস। শিবির প্যানেলের সম্ভাব্য জয় আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে, কারণ এটি ছাত্র রাজনীতিতে ধর্মীয় সংগঠনের প্রভাব বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিতে পারে।
চ্যালেঞ্জ ও ঐতিহাসিক সম্ভাবনা
নির্বাচনের ফলাফল ছাত্র রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণ করবে। ফেসবুক পোস্ট এবং স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে শিবির প্যানেলের জয়ের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা জোরদার হচ্ছে। তবে, সামাজিক মাধ্যমে নারী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও বডি শেমিং-এর অভিযোগ উঠেছে, যা নির্বাচনের উৎসবমুখর পরিবেশে ছায়া ফেলেছে। বিডিএসসি’র অভ্যন্তরীণ বিভক্তি এবং জেসিডি’র দুর্বল প্রচারণা শিবিরের জন্য সুবিধা তৈরি করেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
ডাকসু নির্বাচন ২০২৫ বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে একটি ঐতিহাসিক মোড় হতে পারে। ইসলামী ছাত্র শিবিরের ভিপি, জিএস এবং এজিএস পদে সম্ভাব্য জয় ডাকসুর ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। তবে, অনিয়মের অভিযোগ এবং সামাজিক মাধ্যমে বিভক্ত মতামত নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। ভোট গণনার ফলাফল এবং এর পরবর্তী প্রভাব বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।