ITGenius24 Logo

Sunday, November 23, 2025 03:32 AM

ডাকসু নির্বাচন: গৌরবময় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও রাজনীতির আঁতুড়ঘর

ডাকসু নির্বাচন: গৌরবময় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও রাজনীতির আঁতুড়ঘর
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) কেবল একটি ছাত্র সংগঠন নয়, এটি বাংলাদেশের ইতিহাস এবং রাজনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত প্রতিটি গণআন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে কাজ করেছে এই প্রতিষ্ঠান। কয়েক দশকের দীর্ঘ বিরতির পর আবারও ডাকসু নির্বাচনের আলোচনায় মুখর হয়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। দীর্ঘ ২৮ বছর পর ২০১৯ সালে একবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও তারপর আবার অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। অবশেষে, নতুন করে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণায় আশার আলো দেখছেন শিক্ষার্থীরা।

গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও ঐতিহ্য:
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার এক বছর পরেই, ১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ' নামে এর যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে এর নাম 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ' বা ডাকসু রাখা হয়। প্রতিষ্ঠার পর প্রথম ভিপি মনোনীত হলেও, শিক্ষার্থীদের সরাসরি ভোটে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৩ সালে। সেই নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন এস এ বারী এবং জিএস নির্বাচিত হন জুলমত আলী খান।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ডাকসু বাংলাদেশের প্রতিটি ঐতিহাসিক সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। '৫২-র ভাষা আন্দোলন, '৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, '৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ডাকসুর নেতারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ডাকসুর নেতৃবৃন্দের সাহসী উদ্যোগেই ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল।একারণে ডাকসুকে বলা হয় বাংলাদেশের রাজনীতির আঁতুড়ঘর এবং দেশের দ্বিতীয় সংসদ।

জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব:
ডাকসু দেশের ভবিষ্যত নেতৃত্ব তৈরির এক উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। ডাকসুর মঞ্চ থেকে উঠে আসা বহু নেতা পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, আমানউল্লাহ আমান এবং খায়রুল কবির খোকনের মতো বহু নেতা একসময় ডাকসুর নেতৃত্বে ছিলেন। এই নেতাদের অনেকেই পরবর্তীতে মন্ত্রী এবং জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, ডাকসু নির্বাচন নিয়মিত না হওয়ায় জাতীয় রাজনীতিতে যোগ্য নেতৃত্বের সংকট তৈরি হয়েছে। ছাত্র রাজনীতির সুস্থ ধারা ব্যাহত হওয়ায় এবং নতুন নেতৃত্ব উঠে না আসায় রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের প্রভাব বেড়েছে বলে অনেকে মনে করেন।[

নির্বাচনের দীর্ঘ খরা ও ২০১৯ সালের নির্বাচন:
১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী शासনের অবসানের পর ডাকসু নির্বাচনও থেমে যায়। ১৯৯০ সালের ৬ জুন সর্বশেষ নির্বাচনের পর দীর্ঘ ২৮ বছর ডাকসুর কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীরা এবং কয়েকটি ছাত্র সংগঠন দাবি তুললেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি।

অবশেষে, উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্বাচনের উদ্যোগ নেয় এবং ২০১৯ সালের ১১ মার্চ বহু প্রতীক্ষিত ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে নির্বাচিত হন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্রার্থী নুরুল হক নুর এবং সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে জয়ী হন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গোলাম রাব্বানী। তবে সেই নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন প্যানেলের পক্ষ থেকে অনিয়মের অভিযোগও উঠেছিল।

বর্তমান পরিস্থিতি ও আগামীর নির্বাচন:
২০১৯ সালে নির্বাচিত কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর করোনা মহামারীসহ বিভিন্ন কারণে আর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। প্রায় ছয় বছর পর, ২০২৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করে নতুন তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। এই নির্বাচনকে ঘিরে ক্যাম্পাসে আবারো ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে।

ইতিমধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, ছাত্র অধিকার পরিষদ এবং বিভিন্ন বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের জোট তাদের নিজ নিজ প্যানেল ঘোষণা করেছে এবং মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছে। কেন্দ্রীয় ২৮টি এবং ১৮টি হল সংসদের বিভিন্ন পদের বিপরীতে বিপুল সংখ্যক প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে নির্বাচনের আগ্রহকে তুলে ধরে।

শিক্ষার্থীরা আশা করছেন, এই নির্বাচনের মাধ্যমে আবারো ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের এবং মত প্রকাশের একটি গণতান্ত্রিক মঞ্চ তৈরি হবে। একটি সফল ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ডাকসু তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে এবং জাতীয় রাজনীতিতে নতুন ও যোগ্য নেতৃত্ব সরবরাহের ঐতিহাসিক ধারাকে অব্যাহত রাখবে - এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।