বেইজিং: চীন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) খাতে বিশ্ব নেতৃত্বের লক্ষ্যে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০২৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে দেশটির রাজধানী বেইজিং-এ সকল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে AI শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এই উদ্যোগের আওতায় শিক্ষার্থীদের প্রতি বছর কমপক্ষে আট ঘণ্টা AI-সম্পর্কিত পাঠ গ্রহণ করতে হবে।
চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই নতুন শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য শিশুদের ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের জগতে প্রবেশ করানো। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীরা খেলার ছলে এবং হাতে-কলমে কার্যক্রমের মাধ্যমে AI-এর মৌলিক ধারণা শিখবে। মাধ্যমিক স্তরে তারা চিকিৎসা, কৃষি, এবং ট্রাফিক ব্যবস্থার মতো ক্ষেত্রে AI-এর ব্যবহার সম্পর্কে জানবে। উচ্চমাধ্যমিকে শিক্ষার্থীরা মেশিন লার্নিং, ডেটা অ্যানালাইসিস, এবং AI-এর নৈতিক দিক নিয়ে পড়াশোনা করবে।
চীনের শিক্ষামন্ত্রী হুয়াই জিনপেং বলেছেন, “AI শুধু একটি প্রযুক্তি নয়, এটি শিক্ষার গতিপ্রকৃতি বদলে দেওয়ার মতো একটি রূপান্তরকারী শক্তি। আমাদের লক্ষ্য হলো শিশুদের ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত করা।” তিনি আরও জানান, ২০২৫ সালের মধ্যে একটি জাতীয় AI শিক্ষার হোয়াইট পেপার প্রকাশিত হবে, যেখানে এই শিক্ষানীতির কাঠামো, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, এবং বাস্তবায়ন পরিকল্পনা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ থাকবে।
বেইজিং-এর স্কুলগুলোতে ইতোমধ্যে AI শিক্ষার পাইলট প্রকল্প চালু হয়েছে। গত ডিসেম্বরে দেশব্যাপী ১৮৪টি স্কুলকে এই প্রকল্পের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল। শিক্ষার্থীরা কেবল AI-এর তাত্ত্বিক দিক নয়, বরং চ্যাটবটের ব্যবহার, প্রযুক্তিগত প্রয়োগ, এবং এর নৈতিক দিক নিয়েও আলোচনা করছে। উদাহরণস্বরূপ, বেইজিং-এর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছয় বছরের এক শিক্ষার্থী, লি ওয়েই, জিজ্ঞেস করেছিল, “চ্যাটবট কি আমাদের মতো হাসতে পারে?” শিক্ষক চেন মিং উত্তর দিয়েছিলেন, “আমরা এখন সেটাই শিখতে যাচ্ছি।” এই ধরনের ক্লাসরুম আলোচনা শিশুদের মধ্যে AI নিয়ে কৌতূহল জাগিয়ে তুলছে।
বিশ্লেষকদের মতে, চীনের এই উদ্যোগ শুধু ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রযুক্তিতে দক্ষ করে তোলার জন্য নয়, বরং দেশটির দীর্ঘমেয়াদি উদ্ভাবনী সক্ষমতা এবং প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা বাড়াতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই পদক্ষেপকে অনেকে ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে দেখছেন, যা চীনকে AI-কেন্দ্রিক বিশ্বে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।
অন্যদিকে, এই উদ্যোগ আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, এবং ইতালির মতো দেশগুলো ইতোমধ্যে তাদের শিক্ষাব্যবস্থায় AI-কে অন্তর্ভুক্ত করেছে, তবে চীনের মতো এত ব্যাপক এবং পরিকল্পিত উদ্যোগ এখনও দেখা যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, “AI শিক্ষা এখন আর বিলাসিতা নয়, এটি একটি মৌলিক প্রয়োজন। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকেও এই দিকে এগিয়ে যেতে হবে।”
চীনের এই শিক্ষা বিপ্লব শুধু ক্লাসরুমে সীমাবদ্ধ নয়। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন প্রকল্পে অংশ নিচ্ছে, যা তাদের সৃজনশীলতা ও সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা বাড়াচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, বেইজিং-এর দশ বছর বয়সী শিক্ষার্থী ঝাং লিং বলেন, “আমি চাই AI দিয়ে খেলনা তৈরি করতে, যা বাচ্চাদের পড়াশোনায় সাহায্য করবে।” এই উদ্যোগ চীনের নতুন প্রজন্মের মধ্যে প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তুলছে, যারা ভবিষ্যতে AI প্রযুক্তির নেতৃত্ব দেবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
সূত্র: রয়টার্স, বিজ্ঞানী.অর্গ, ইত্তেফাক