বাংলাদেশের অর্থনীতি গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, যার পেছনে তরুণ উদ্যোক্তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। নতুন উদ্যোক্তারা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং উদ্ভাবনী সমাধানের মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। তবে, তাদের পথে রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের নতুন উদ্যোক্তাদের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে তথ্যভিত্তিক আলোচনা করা হলো।
সম্ভাবনা
১. ডিজিটাল অর্থনীতির উত্থান
বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ডিজিটাল স্টার্টআপের জন্য বিশাল বাজার সৃষ্টি করেছে। ই-কমার্স, রাইড-শেয়ারিং, শিক্ষা প্রযুক্তি (এডটেক), এবং স্বাস্থ্য প্রযুক্তি (হেলথটেক) খাতে উদ্যোক্তারা সাফল্য পাচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ, ‘পাঠাও’ এবং ‘চালডাল’ এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে লাখো মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করেছে।
২. তরুণ জনগোষ্ঠীর শক্তি
বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৬০% তরুণ, যারা প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা নিয়ে এগিয়ে আসছেন। এই তরুণ প্রজন্ম নতুন ব্যবসার আইডিয়া নিয়ে কাজ করছে, যেমন পরিবেশবান্ধব প্যাকেজিং, টেলি-মেডিসিন, এবং পোষা প্রাণীর যত্ন সেবা। এই খাতগুলোতে প্রতিযোগিতা কম এবং সম্ভাবনা বেশি।
৩. সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ
সরকারের আইসিটি মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) উদ্যোক্তাদের জন্য বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করছে। স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেডের মতো প্রতিষ্ঠান তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য বিনিয়োগ ও পরামর্শ সেবা দিচ্ছে। এছাড়া, ব্র্যাক এবং অন্যান্য এনজিও নতুন উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে।
৪. কৃষি ও পোশাক শিল্পে নতুন দিগন্ত
কৃষি খাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, যেমন আই ফার্মারের মতো প্ল্যাটফর্ম, কৃষকদের জন্য নতুন ব্যবসার সুযোগ তৈরি করছে। তৈরি পোশাক শিল্পে পশ্চাৎ-সংযোগ শিল্পের বিকাশ এবং উচ্চমূল্যের পণ্য রপ্তানির প্রচেষ্টা উদ্যোক্তাদের জন্য সম্ভাবনা বাড়িয়েছে।
৫. বৈদেশিক বিনিয়োগের সম্ভাবনা
বিশ্বব্যাংকের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারের বৈদেশিক বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা ছিল, যা উদ্যোক্তাদের জন্য মূলধন সংগ্রহের সুযোগ বাড়ায়। বিদ্যুৎ, জ্বালানি, এবং টেলিযোগাযোগ খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করছে।
চ্যালেঞ্জ
১. আর্থিক সীমাবদ্ধতা
নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য মূলধন সংগ্রহ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ব্যাংক ঋণ পাওয়ার প্রক্রিয়া জটিল এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করা কঠিন। স্টার্টআপ বাংলাদেশের মতো প্রতিষ্ঠান থাকলেও, অনেক উদ্যোক্তার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল পাওয়া কঠিন।
২. ব্যবসায়িক পরিবেশের জটিলতা
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা লাইসেন্স, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ, এবং দুর্নীতির মতো সমস্যার সম্মুখীন হন। এই প্রতিবন্ধকতাগুলো নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠার পথে বাধা সৃষ্টি করে।
৩. দক্ষতা ও জ্ঞানের অভাব
অনেক তরুণ উদ্যোক্তার ব্যবসা পরিচালনার যথাযথ জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব রয়েছে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এর ভাইস প্রেসিডেন্ট রাসেল টি আহমেদের মতে, অপর্যাপ্ত জ্ঞানের কারণে অনেক স্টার্টআপ ব্যর্থ হয়।
৪. তৈরি পোশাক শিল্পে সীমিত সুযোগ
তৈরি পোশাক শিল্পে নতুন উদ্যোক্তাদের প্রবেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য কঠোর নিয়মকানুন এবং উচ্চ বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা ছোট আকারের কারখানা স্থাপনকে চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে।
৫. জ্বালানি সংকট ও মূল্যস্ফীতি
সিপিডির গবেষণা অনুযায়ী, ৬৬% ব্যবসায়ী জ্বালানি সংকটকে প্রধান ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এছাড়া, মূল্যস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা উদ্যোক্তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণে বাধা দিচ্ছে।
সমাধানের পথ
- আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধি: সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত সহজ শর্তে ঋণ ও বিনিয়োগের সুযোগ বাড়ানো।
- দক্ষতা উন্নয়ন: উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসা পরিচালনা, বিপণন, এবং প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
- ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নতি: লাইসেন্স প্রক্রিয়া সহজীকরণ, দুর্নীতি হ্রাস, এবং জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা।
- উদ্ভাবনী চিন্তার প্রসার: স্টার্টআপ বাংলাদেশের মতো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নতুন আইডিয়াকে উৎসাহিত করা।
বাংলাদেশের নতুন উদ্যোক্তারা দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন। ডিজিটাল অর্থনীতি, তরুণ জনগোষ্ঠী, এবং সরকারি উদ্যোগ তাদের জন্য অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। তবে, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, ব্যবসায়িক জটিলতা, এবং জ্বালানি সংকটের মতো চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে। সঠিক নীতি ও সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা বিশ্বমঞ্চে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে।