Website Logo

Sunday, July 27, 2025 12:19 PM

ডা. মুহাম্মদ ইউনূস: প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সফলতা ও ব্যর্থতার পর্যালোচনা

ডা. মুহাম্মদ ইউনূস: প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সফলতা ও ব্যর্থতার পর্যালোচনা

ডা. মুহাম্মদ ইউনূস, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট থেকে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ক্ষুদ্রঋণ ধারণার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছেন। তবে, তাঁর বর্তমান ভূমিকায় সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে বিতর্ক চলমান রয়েছে। এই প্রতিবেদনে তাঁর কার্যকলাপের সফলতা ও ব্যর্থতা বিশ্লেষিত হবে।

সফলতার অধ্যায়

রিজার্ভ সংরক্ষণবাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ ১৬.৭৭ থেকে ২৪ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে রয়েছে, যা তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে সক্ষম। আইএমএফ-এর শর্ত পূরণে নিট রিজার্ভ ১৪.৭ বিলিয়ন ডলার রাখা হয়েছে।

বকেয়া পরিশোধ : এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মে-জুন মাসের আমদানি বিল সহ বিভিন্ন স্বল্পমেয়াদী দায়-দেনা পরিশোধে সরকার সফল হয়েছে, যা রিজার্ভের উপর চাপ কমিয়ে দিয়েছে। রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করে বিকল্প উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।

রেমিট্যান্স বৃদ্ধি প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানো বৃদ্ধি পেয়েছে, যা রিজার্ভ সংরক্ষণে সহায়ক হয়েছে। গত দুই মাসে এই প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।


আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ও কূটনৈতিক সাফল্যজাতিসংঘ অধিবেশনে অংশগ্রহণ ও চীন, থাইল্যান্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোতে সফরে তিনি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন দেশের নেতৃত্ব তাঁর নেতৃত্বে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

বিমসটেকের নেতৃত্ব বাংলাদেশকে বিমসটেকের চেয়ারম্যান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা তাঁর নেতৃত্বের একটি বড় অর্জন।

ভারতের সাথে কূটনৈতিক দৃঢ়তাভারতের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে তিনি সমতাভিত্তিক সম্পর্কের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

নৈতিক নেতৃত্বের প্রতীকনেতিবাচক প্রচার, দলীয় সংঘাত ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বের মাঝে ডা. ইউনূস এক নৈতিক ও গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। তিনি দলীয় রাজনীতিতে না জড়িয়ে নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগকে আন্তর্জাতিক ও নাগরিক সমাজে গ্রহণযোগ্যতা প্রদান করেছেন। তরুণ প্রজন্ম, নাগরিক সমাজ ও পেশাজীবী মহল তাঁর উদার চিন্তাধারায় আস্থা প্রকাশ করছে।

সংলাপ ও সহনশীলতার বার্তা বৈশ্বিক নাগরিক মানসিকতা নিয়ে তিনি সংলাপ, সহনশীলতা ও অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির পক্ষে। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তিনি রাজনৈতিক মতপার্থক্য নিরসনে গঠনমূলক আলোচনা ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠায় কাজ করছেন। তিনি সমঝোতার সেতুবন্ধন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন।

নীতি ও কৌশলগত পরামর্শে দক্ষতা : অর্থনীতি ও উন্নয়নের অভিজ্ঞতা ছাড়াও তিনি একটি দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধি। দলীয় নীতিমালা প্রণয়ন, নির্বাচন কৌশল, জনসম্পৃক্ততা ও সামাজিক সমস্যা নিরসনে উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গি আনতে তাঁর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক ব্যবসা মডেল, নির্বাচনী ব্যয় স্বচ্ছতা ও প্রযুক্তিনির্ভর ক্যাম্পেইন রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুনত্ব এনেছে।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি :  তাঁর উপস্থিতি আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও কূটনৈতিক মহলে দলের পরিচিতি ও বিশ্বাসযোগ্যতা বহুগুণে বাড়িয়েছে। উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর আস্থা ও বিনিয়োগ আকর্ষণে তাঁর পরিচিতি এক শক্তিশালী পুঁজি।

চ্যালেঞ্জের মাঝে স্থিরতা : তাঁর বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিতর্ক ও মামলা সত্ত্বেও তিনি শান্ত, পরিশীলিত ও ইতিবাচক বার্তা দিয়ে রাজনৈতিক পরিবেশকে ভারসাম্যপূর্ণ করছেন।


রাজনৈতিক ব্যর্থতার মূল দিকসমূহ

দলীয় পক্ষপাত : এনসিপির প্রতি অতিরিক্ত সমর্থন ও ছাত্র নেতৃত্বের পক্ষপাত বিএনপি ও অন্যান্য দলের অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে।

অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক দুর্বলতা: প্রথম ১০০ দিনে প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা ও জনসেবায় কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি লাভে ব্যর্থতা ঘটেছে।

মব রাজনীতি ও বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা : দলবদ্ধ আন্দোলন ও বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ উঠেছে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপের অভাব : পূর্ববর্তী সরকারের দুর্নীতি নিরসনে দৃশ্যমান ব্যবস্থা গ্রহণে বিলম্ব হয়েছে, যা জনমনে হতাশা সৃষ্টি করেছে।

পদত্যাগের আলোচনা : চলমান পরিস্থিতি ও প্রতিবন্ধকতার কারণে তিনি পদত্যাগ বিবেচনা করছেন, যা নেতৃত্বে সংকটের ইঙ্গিত দেয়।

সংস্কারের দিকে এগোনোর বিলম্ব : নির্বাচন, গণহত্যা বিচার ও প্রশাসনিক সংস্কারে ত্বরান্বিত পদক্ষেপের অভাব সমালোচনা আকর্ষণ করেছে।

সামাজিক অবিশ্বাস : কিছু পক্ষ তাঁকে "মানি লন্ডারার" ও "রক্তচোষা" হিসেবে অভিযুক্ত করেছে, যা তাঁর খ্যাতির উপর প্রশ্ন তুলেছে, যদিও এসব অভিযোগ প্রমাণিত নয়।

নির্বাচনী বাস্তবতায় অভিজ্ঞতার অভাব : রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার অভাবে তিনি রাজনৈতিক কৌশল ও জনগণের অনুভূতি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁর তাত্ত্বিক পরামর্শ প্রায়ই বাস্তব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রযোজ্য হয়নি।

রাজনৈতিক বাস্তবতায় নরম অবস্থান বিরোধী ও সরকারের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টায় স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণে ব্যর্থতা ঘটেছে। "সব পক্ষকে খুশি রাখার কৌশল" কোনো পক্ষের পূর্ণ আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।

ডা. ইউনূস শুধু একটি দলের উপদেষ্টা নন, বরং একটি নতুন রাজনৈতিক মানসিকতার প্রতিনিধি। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ধারা ভবিষ্যতে স্বচ্ছ রাজনীতির মডেল হতে পারে। যদিও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তাঁর কৌশলগত দিকনির্দেশনা ও নৈতিক অবস্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।