বাংলাদেশে চাঁদাবাজি এবং মাফিয়া কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরে সমাজ ও অর্থনীতির জন্য একটি গুরুতর সমস্যা। এই সমস্যা আরও জটিল হয়ে উঠেছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মদদের কারণে, যারা প্রায়শই এই অপরাধী চক্রগুলোকে সুরক্ষা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে। এই প্রতিবেদনে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা, চাঁদাবাজ ও মাফিয়া চক্রের শক্তিশালীকরণের প্রক্রিয়া, এর প্রভাব এবং সমাধানের সম্ভাব্য পথ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা, চাঁদাবাজ ও মাফিয়া চক্রকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের মদদের কিছু প্রধান দিক নিম্নরূপ:
- পৃষ্ঠপোষকতা ও সুরক্ষা: রাজনৈতিক নেতারা প্রায়শই তাদের রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে চাঁদাবাজ ও মাফিয়া চক্রকে আইনের হাত থেকে রক্ষা করে। উদাহরণস্বরূপ, পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় ভাঙারি পণ্যের ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগের হত্যার ঘটনায় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস অভিযোগ করেছে যে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের দীর্ঘদিনের পৃষ্ঠপোষকতায় চাঁদাবাজি একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।
- দখলদারিত্ব ও নিয়ন্ত্রণ: স্থানীয় নেতারা বাজার, দোকানপাট, পরিবহন এবং নির্মাণ খাতে অবৈধ দখলদারিত্ব ও চাঁদাবাজির জন্য মাফিয়া চক্রকে সহায়তা करता। বাংলাদেশ পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (ডিআইজি) জিল্লুর রহমান ২০২৪ সালের এক সেমিনারে বলেছেন, চাঁদাবাজির জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব ৫০ শতাংশ দায়ী, এবং পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ৪৯ শতাংশ দায়ী।
- দলীয়করণ ও নিয়োগ: রাজনৈতিক নেতারা প্রশাসনের দুর্নীতিগ্রস্ত অংশের সঙ্গে যোগসাজশ করে চাঁদাবাজ ও মাফিয়া চক্রের সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম অভিযোগ করেছেন যে একটি রাজনৈতিক দল পুরাতন বন্দোবস্ত টিকিয়ে রেখে চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে দেশকে শোষণ করতে চায়।
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মদদে চাঁদাবাজ ও মাফিয়া চক্র শক্তিশালী হওয়ার প্রক্রিয়াগুলো নিম্নরূপ:
- অবৈধ আর্থিক লেনদেন: রাজনৈতিক নেতারা চাঁদাবাজি থেকে প্রাপ্ত অর্থের একটি অংশ গ্রহণ করে, যা তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম ও প্রভাব বজায় রাখতে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার নিউমার্কেট এলাকায় ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়, যার একটি বড় অংশ স্থানীয় নেতাদের হাতে যায়।
- প্রশাসনিক দুর্নীতি: প্রশাসনের কিছু অংশ, বিশেষ করে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মিলে চাঁদাবাজ ও মাফিয়া চক্রকে সহায়তা করে। এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, “দুর্নীতি যারাই করবে, এনসিপি তাদের ছাড় দেবে না।”
- সন্ত্রাসী কার্যক্রম: রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থনে মাফিয়া চক্র সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে, যেমন ভাঙচুর, হুমকি এবং হত্যা। ময়মনসিংহে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের জন্য সরঞ্জাম ভাঙচুর এবং হুমকি দেওয়া হয়।
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মদদে চাঁদাবাজ ও মাফিয়া চক্রের শক্তিশালীকরণের ফলে সমাজ ও অর্থনীতির উপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে:
- অর্থনৈতিক ক্ষতি: চাঁদাবাজির কারণে ব্যবসায়ীদের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়, যা পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির দিকে নিয়ে যায়। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকায় প্রায় তিন লাখ হকার দৈনিক গড়ে ১৯২ টাকা চাঁদা দিতে বাধ্য হয়, যা জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষতি সাধন করে।
- সামাজিক অস্থিরতা: চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সাভারের এনএফভিআই শপিং কমপ্লেক্সে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যবসায়ীরা নিয়মিত হুমকি ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
- আইনশৃঙ্খলার অবনতি: রাজনৈতিক নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রশাসনের দুর্নীতিগ্রস্ত অংশ চাঁদাবাজ ও মাফিয়া চক্রকে আরও বেপরোয়া করে তুলেছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, “চাঁদাবাজ-দখলদারদের কেন ধরা হচ্ছে না?”
বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন সংগঠন এই সমস্যা মোকাবেলায় কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে:
- আইন প্রয়োগ: ২০২৫ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ অভিযানে ৩৮৩ জন চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
- রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতিবাদ: জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। নাহিদ ইসলাম ঘোষণা করেছেন, “আগামীর আন্দোলন দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে।”
- জনসচেতনতা বৃদ্ধি: সাভার, ময়মনসিংহ এবং ধামইরহাটে জনগণ মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশের মাধ্যমে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে।
চাঁদাবাজি ও মাফিয়া চক্র দমনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
- রাজনৈতিক দলীয়করণ: রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ এবং পরিবারতন্ত্র চাঁদাবাজ ও মাফিয়া চক্রকে আরও শক্তিশালী করেছে। বিএনপি নেতা ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেছেন, “প্রশাসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের যেসব লোক ঘাপটি মেরে আছে, তাদের চাকরি থেকে বিতাড়িত করতে হবে।”
- প্রশাসনিক দুর্নীতি: প্রশাসনের দুর্নীতিগ্রস্ত অংশের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের যোগসাজশ এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে।
- জনগণের ভয়: সাধারণ মানুষ প্রায়শই চাঁদাবাজ ও মাফিয়া চক্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ভয় পায়।
সমাধানের প্রস্তাবনা
- কঠোর আইন প্রয়োগ: বিদ্যমান আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং চাঁদাবাজ ও মাফিয়া চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ডিআইজি জিল্লুর রহমান বলেছেন, “আইন প্রণয়নের দরকার নেই, বিদ্যমান আইনের সঠিক প্রয়োগই যথেষ্ট।”
- প্রশাসনিক সংস্কার: প্রশাসনের দুর্নীতিগ্রস্ত অংশকে চিহ্নিত করে তাদের অপসারণ এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
- রাজনৈতিক সদিচ্ছা: রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে আন্তরিক অবস্থান গ্রহণ করতে হবে।
- জনসচেতনতা বৃদ্ধি: জনগণকে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উৎসাহিত করতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন।
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মদদে চাঁদাবাজ ও মাফিয়া চক্র বাংলাদেশে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, যা দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য বড় হুমকি। এই সমস্যা সমাধানে কঠোর আইন প্রয়োগ, প্রশাসনিক সংস্কার, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং জনসচেতনতার সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। শুধুমাত্র সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমেই এই সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্তি সম্ভব।