Website Logo

Sunday, July 27, 2025 11:51 AM

বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর বিমান দুর্ঘটনা: একটি মর্মান্তিক ইতিহাস

বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর বিমান দুর্ঘটনা: একটি মর্মান্তিক ইতিহাস

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে বাংলাদেশে বিমান দুর্ঘটনার একটি দুঃখজনক ইতিহাস রয়েছে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনী এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন খাতে ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনাগুলোতে উল্লেখযোগ্য প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এই প্রতিবেদনে ১৯৭১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য বিমান দুর্ঘটনার সংখ্যা এবং এর ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তুলে ধরা হয়েছে।

বিমান দুর্ঘটনার সংখ্যা

বাংলাদেশ বিমানবাহিনী এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন খাতে স্বাধীনতার পর থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য দুর্ঘটনার সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন সূত্রে তথ্য পাওয়া যায়। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ক্ষেত্রে, ১৯৯১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ৩২টি বড় বিমান দুর্ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়, যেখানে একদিনে ৪৪টি বিমান ধ্বংস হয়ে যায়।

বেসামরিক বিমান পরিবহন খাতে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দুর্ঘটনার মধ্যে রয়েছে ১৯৮৪ সালের ৫ আগস্টের ফকার এফ ২৭-৬০০ দুর্ঘটনা, যেখানে ৪৯ জন নিহত হয়। এটি বাংলাদেশের মাটিতে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে ভয়াবহ বেসামরিক বিমান দুর্ঘটনা। এছাড়া, ১৯৯৭ সালের ২২ ডিসেম্বর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিজি ৬০৯ ধানখেতে বিধ্বস্ত হয়ে ১৭ জন আহত হয়।

সামগ্রিকভাবে, বিমানবাহিনী এবং বেসামরিক খাত মিলিয়ে ১৯৭১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত অন্তত ৩৫টি উল্লেখযোগ্য বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে, যদিও সঠিক সংখ্যা তদন্ত ও রিপোর্টিংয়ের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে।

উল্লেখযোগ্য দুর্ঘটনা

নিম্নে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দুর্ঘটনার বিবরণ দেওয়া হলো:

  1. ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়: বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। একদিনে ৪৪টি বিমান ধ্বংস হয়, যার মধ্যে পাঁচটি মিল এমআই-১৭ হেলিকপ্টারও ছিল। এই ঘটনায় বিমানবাহিনীর সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

  2. ১৯৮৪ সাল, ৫ আগস্ট: বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফকার এফ ২৭-৬০০ জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে জলাভূমিতে বিধ্বস্ত হয়। এতে ৪৯ জন নিহত হন। এটি ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়াবহ বেসামরিক বিমান দুর্ঘটনা।

  3. ২০১৫ সাল, ২৯ জুন: এফ-৭এমবি যুদ্ধবিমান পতেঙ্গা উপকূলে বিধ্বস্ত হয়, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তাহমিদ নিহত হন।

  4. ২০২৪ সাল, ৯ মে: ইয়াক-১৩০ প্রশিক্ষণ বিমান কর্ণফুলী নদীর মোহনায় বিধ্বস্ত হয়। দুই বৈমানিক প্যারাসুটে অবতরণ করলেও স্কোয়াড্রন লিডার মুহাম্মদ আসিম জাওয়াদ মারা যান।

  5. ২০২৫ সাল, ২১ জুলাই: উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে এফ-৭ বিজিআই প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। এই দুর্ঘটনায় ৩১ জন নিহত হন, যাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। আহত হন ১৬৫ জন। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিরল ও ভয়াবহ দুর্ঘটনা।

ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ

বিমান দুর্ঘটনার ফলে প্রাণহানি, আহত ব্যক্তি এবং সম্পদের ক্ষতি উল্লেখযোগ্য। নিম্নে ক্ষয়ক্ষতির একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো:

  • প্রাণহানি: ১৯৮৪ সালের ফকার এফ ২৭ দুর্ঘটনায় ৪৯ জন এবং ২০২৫ সালের উত্তরার দুর্ঘটনায় ৩১ জন নিহত হন। এছাড়া, বিমানবাহিনীর বিভিন্ন দুর্ঘটনায় ফ্লাইট ক্যাডেট, স্কোয়াড্রন লিডার এবং প্রশিক্ষকদের প্রাণহানি ঘটেছে। সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা কঠিন, তবে শতাধিক প্রাণহানির রেকর্ড পাওয়া যায়।

  • আহত ব্যক্তি: উত্তরার দুর্ঘটনায় ১৬৫ জন আহত হন, যাদের মধ্যে অনেকে গুরুতর অবস্থায় চিকিৎসাধীন। অন্যান্য দুর্ঘটনায়ও শতাধিক আহতের তথ্য রয়েছে।

  • সম্পদের ক্ষতি: ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ৪৪টি বিজিআই এবং অন্যান্য বিমান ধ্বংস হয়, যা বিমানবাহিনীর জন্য বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি। বেসামরিক খাতে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ২০০৫-০৬ অর্থবছরে প্রায় ১২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

  • পরোক্ষ ক্ষতি: দুর্ঘটনাগুলোর ফলে বিমানবাহিনী ও বেসামরিক বিমান সংস্থাগুলোর জনবল সংকট, প্রশিক্ষণ ব্যয় বৃদ্ধি এবং জনগণের আস্থা হ্রাসের মতো পরোক্ষ ক্ষতি হয়েছে। ১৯৭৭ সালের বিদ্রোহের পর বিমানবাহিনীর জনবল ভয়াবহভাবে হ্রাস পায়।

তদন্ত ও সতর্কতা

বাংলাদেশ বিমানবাহিনী এবং বেসামরিক বিমান সংস্থাগুলো দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠন করে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৫ সালের উত্তরার দুর্ঘটনার পর আইএসপিআর জানায়, বিমানটি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিধ্বস্ত হয়। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আর্থিক ও চিকিৎসা সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সম্প্রতি এয়ার ইন্ডিয়ার দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের বোয়িং-৭৮৭ ড্রিমলাইনারের রক্ষণাবেক্ষণ জোরদার করেছে, যা ভবিষ্যৎ দুর্ঘটনা রোধে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

সমবেদনা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

২০২৫ সালের উত্তরার দুর্ঘটনায় ভারত, পাকিস্তান, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং সুইজারল্যান্ড গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং অন্যান্য নেতারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে বিমান দুর্ঘটনাগুলো জাতির জন্য বড় ধরনের ট্র্যাজেডি। বিমানবাহিনী এবং বেসামরিক খাতে ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনাগুলো প্রাণহানি, সম্পদের ক্ষতি এবং জনগণের মনে ভীতির সৃষ্টি করেছে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত রক্ষণাবেক্ষণ, প্রশিক্ষণ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে ভবিষ্যৎ দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।