পৃথিবী একটি ভাষার সমুদ্রে ভাসমান মহাবিশ্ব। মানব সভ্যতার ইতিহাসের শুরু থেকেই মানুষ তাদের ভাব প্রকাশের জন্য ভাষার সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে পৃথিবীতে আনুমানিক ৭,০০০টিরও বেশি ভাষা রয়েছে। এই ভাষাগুলোর মধ্যে কিছু ভাষায় কোটি কোটি মানুষ কথা বলেন, আবার কিছু ভাষা এতটাই সীমিত যে মাত্র কয়েকশ মানুষই সেগুলো ব্যবহার করেন। ইউনেস্কো এবং "Ethnologue"-এর মতে, বিশ্বের ভাষার এই বৈচিত্র্য প্রতিটি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, ইতিহাস ও পরিচয় বহন করে।
পৃথিবীর এই প্রায় সাত হাজার ভাষার মধ্যে কিছু ভাষা বিপন্ন, কারণ সেগুলোর ব্যবহারকারী সংখ্যা দিন দিন কমছে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি দুই সপ্তাহে একটি করে ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ হলো গ্লোবালাইজেশন, নগরায়ন এবং প্রজন্মের পর প্রজন্মে ভাষান্তর না হওয়া। বিশেষ করে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষাগুলো এই বিপদের মুখে পড়ছে। তবুও পৃথিবীর জনসংখ্যার একটি বড় অংশ মাত্র কিছু নির্দিষ্ট ভাষায় কথা বলে।
বিশ্বের সর্বাধিক কথিত ভাষাগুলোর তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ইংরেজি ভাষা। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, ইংরেজি ভাষায় বিশ্বের প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ কথা বলেন, যার মধ্যে প্রায় ৪০ কোটি মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহার করেন এবং বাকিরা দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি জানেন। ইংরেজির এই জনপ্রিয়তার পেছনে রয়েছে ইতিহাস, উপনিবেশবাদের প্রভাব, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, আন্তর্জাতিক ব্যবসা এবং ইন্টারনেট।
দ্বিতীয় সর্বাধিক কথিত ভাষা হলো ম্যান্ডারিন চীনা। যদিও ম্যান্ডারিন মূলত চীনে সীমাবদ্ধ, তবে প্রায় ১১৫ কোটি মানুষ এটি ব্যবহার করে, যাদের বেশিরভাগই মাতৃভাষাভাষী। চীনের বিপুল জনসংখ্যা এবং ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক প্রভাবের কারণে ম্যান্ডারিনের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে।
তৃতীয় স্থানে রয়েছে হিন্দি, যা ভারতের বৃহৎ জনগোষ্ঠী ব্যবহার করে। হিন্দি ভাষায় কথা বলেন প্রায় ৬০ কোটি মানুষ। এরপর রয়েছে স্প্যানিশ ভাষা, যা লাতিন আমেরিকা, স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত হয় এবং প্রায় ৫৫ কোটি মানুষ স্প্যানিশে কথা বলেন।
ভাষার বিস্তৃতি কেবল জনগণের সংখ্যার ওপর নির্ভর করে না, বরং একটি ভাষার সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক শক্তির সাথেও সম্পর্কযুক্ত। ইংরেজি যেমন আন্তর্জাতিক মাধ্যম হিসেবে গৃহীত, তেমনই স্প্যানিশ, ফরাসি ও আরবি ভাষাও বিভিন্ন অঞ্চলে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বাহক।
সবশেষে বলা যায়, পৃথিবীর ভাষাগুলো মানব জাতির সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতিচ্ছবি। এই ভাষাগুলোর সংরক্ষণ আমাদের দায়িত্ব, কারণ একটি ভাষা হারিয়ে যাওয়া মানে একটি সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং পরিচয়ের হারিয়ে যাওয়া। পাশাপাশি, সর্বাধিক কথিত ভাষাগুলোর জ্ঞানার্জন বৈশ্বিক সংযোগ এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার জন্য অপরিহার্য। পৃথিবীর ভাষা-ভাণ্ডার আমাদের সম্পদ, যা সংরক্ষণ ও সম্মান করা উচিত।