২০২৫ সালে বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কা সফর ছিল একটি অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সিরিজ, যেখানে দুটি টেস্ট ম্যাচ, তিনটি ওয়ানডে ইন্টারন্যাশনাল (ওডিআই) এবং তিনটি টি-টোয়েন্টি ইন্টারন্যাশনাল (টি২০আই) ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। জুন থেকে জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত এই সফরে দুই দলই বিভিন্ন ফরম্যাটে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স প্রদর্শন করে। নিচে এই সিরিজের একটি তথ্যবহুল রিপোর্ট দেওয়া হলো, যেখানে ফলাফল, গুরুত্বপূর্ণ পারফরম্যান্স এবং উল্লেখযোগ্য মুহূর্তগুলো তুলে ধরা হয়েছে, বিশেষ করে প্রদত্ত লিঙ্কে উল্লেখিত তৃতীয় টি২০আই ম্যাচের বিশদ বিবরণসহ।
সিরিজের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
সফরে অন্তর্ভুক্ত ছিল:
- ২টি টেস্ট ম্যাচ: শ্রীলঙ্কা সিরিজটি ১-০ তে জিতেছে।
- ৩টি ওডিআই: শ্রীলঙ্কা সিরিজটি ২-১ এ জিতেছে।
- ৩টি টি২০আই: তৃতীয় টি২০আই-এর আগে সিরিজটি ১-১ এ সমতায় ছিল, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তাদের প্রথম টি২০আই সিরিজ জয়ের লক্ষ্যে ছিল।
এই সিরিজ ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং সফর, যেখানে তারা শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞ খেলোয়াড় এবং স্বাগতিক মাঠের সুবিধার বিপক্ষে লড়াই করেছে। টেস্ট এবং ওডিআই সিরিজে হারলেও, বাংলাদেশ টি২০আই সিরিজে তাদের তরুণ খেলোয়াড়দের নিয়ে দুর্দান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখিয়েছে।
টেস্ট সিরিজ (শ্রীলঙ্কা ১-০)
- প্রথম টেস্ট (গল, ১৭-২১ জুন, ২০২৫): ম্যাচটি ড্র হয়। বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে মুশফিকুর রহিমের ১৬৩ এবং নাজমুল হোসেন শান্তর ১৪৮ রানের সুবাদে ৪৯৫ রান করে। শ্রীলঙ্কা পাথুম নিসাঙ্কার ১৮৭ রানে ৪৮৫ রান করে। দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ ২৮৫/৬ ডিক্লেয়ার করে ২৯৬ রানের টার্গেট দেয়, কিন্তু শ্রীলঙ্কা ৭২/৪ তে শেষ করে, তাইজুল ইসলাম ৩/২৩ নেন। বৃষ্টির ব্যাঘাত এবং সতর্ক ব্যাটিং বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
- দ্বিতীয় টেস্ট (কলম্বো, ২৫-২৮ জুন, ২০২৫): শ্রীলঙ্কা ইনিংস এবং ৭৮ রানের ব্যবধানে জয়লাভ করে। শ্রীলঙ্কা নিসাঙ্কার ১৫৮ এবং কুশল মেন্ডিসের ৮৪ রানে ৪৫৮ রান করে। বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ২৪৭ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ১৩৩ রানে অলআউট হয়। প্রবাথ জয়সুরিয়ার ৫/৫৬ ম্যাচ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিসাঙ্কা ম্যাচ সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন।
গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়:
- শ্রীলঙ্কা: পাথুম নিসাঙ্কা (দুই টেস্টে ৩৪৫ রান) এবং প্রবাথ জয়সুরিয়া (দ্বিতীয় টেস্টে ৫ উইকেট)।
- বাংলাদেশ: মুশফিকুর রহিম (প্রথম টেস্টে ১৬৩) এবং নাজমুল হোসেন শান্ত (প্রথম টেস্টে দুটি সেঞ্চুরি)।
ওডিআই সিরিজ (শ্রীলঙ্কা ২-১)
- প্রথম ওডিআই (কলম্বো, ২ জুলাই, ২০২৫): শ্রীলঙ্কা ৭৭ রানে জয়ী। শ্রীলঙ্কা চারিথ আসালাঙ্কার ১০৬ রানে ২৪৪ রান করে। বাংলাদেশ ১০০/১ থেকে ১০৫/৮ এ ধসে ১৬৭ রানে অলআউট হয়। ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা (৪/১০) এবং কামিন্দু মেন্ডিস (৩/১৯) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তানজিদ হাসান (৬২) এবং জাকের আলী (৫১) বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন।
- দ্বিতীয় ওডিআই: বাংলাদেশ তানভীর ইসলামের প্রথম পাঁচ উইকেটের সুবাদে জয়ী হয়ে সিরিজ ১-১ এ সমতায় আনে। বিস্তারিত তথ্য সীমিত, তবে এই জয় বাংলাদেশের প্রত্যাবর্তনের ক্ষমতা প্রদর্শন করে।
- তৃতীয় ওডিআই (ক্যান্ডি, ৮ জুলাই, ২০২৫): শ্রীলঙ্কা ৯৯ রানের জয়ে সিরিজ জিতে নেয়। কুশল মেন্ডিসের ১২৪ এবং আসালাঙ্কার ৫৮ রানে শ্রীলঙ্কা ২৮৫/৭ করে। বাংলাদেশ ১৮৬ রানে অলআউট হয়, আসিথা ফার্নান্দো এবং দুশমান্থা চামিরা তিনটি করে উইকেট নেন। তৌহিদ হৃদয়ের ৫১ রান বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল।
গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়:
- শ্রীলঙ্কা: কুশল মেন্ডিস (সিরিজে ১৬৯ রান) এবং চারিথ আসালাঙ্কা (১৬৪ রান)।
- বাংলাদেশ: তানজিদ হাসান এবং তৌহিদ হৃদয় (হাফ-সেঞ্চুরি) এবং তানভীর ইসলাম (পাঁচ উইকেট)।
টি২০আই সিরিজ (তৃতীয় টি২০আই-এর আগে ১-১)
- প্রথম টি২০আই (পাল্লেকেলে, ১০ জুলাই, ২০২৫): শ্রীলঙ্কা ৭ উইকেটে ৬ বল বাকি থাকতে জয়ী। বাংলাদেশ মোহাম্মদ নাঈম (৩২) এবং শামীম হোসেনের (১৪) অবদানে ১৫৪/৫ করে। শ্রীলঙ্কা কুশল মেন্ডিসের ৭৩ (৫১ বল) এবং পাথুম নিসাঙ্কার আগ্রাসী শুরুতে সহজে টার্গেট তাড়া করে।
- দ্বিতীয় টি২০আই (ডাম্বুলা, ১৩ জুলাই, ২০২৫): বাংলাদেশ ৮৩ রানের জয়ে সিরিজ সমতায় আনে। লিটন দাস (৫০ বলে ৭৬) এবং শামীম হোসেন (২৭ বলে ৪৮) বাংলাদেশকে ১৭৭ রানে নিয়ে যায়। রিশাদ হোসেনের নেতৃত্বে বোলাররা শ্রীলঙ্কাকে ৯৪ রানে অলআউট করে, যা তাদের ঘরের মাঠে সর্বনিম্ন টি২০আই স্কোর। শামীমের কুশল মেন্ডিসের রানআউট এবং দুর্দান্ত ফিল্ডিং ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট ছিল।
গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়:
- শ্রীলঙ্কা: কুশল মেন্ডিস (প্রথম টি২০আই-এ ৭৩) এবং পাথুম নিসাঙ্কা (ওপেনিং জুটি)।
- বাংলাদেশ: লিটন দাস (দ্বিতীয় টি২০আই-এ ৭৬), শামীম হোসেন (ব্যাটিং ও ফিল্ডিং) এবং রিশাদ হোসেন (গুরুত্বপূর্ণ উইকেট)।
তৃতীয় টি২০আই (কলম্বো, ১৬ জুলাই, ২০২৫)
আর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে তৃতীয় টি২০আই ছিল সিরিজ নির্ধারক ম্যাচ। শ্রীলঙ্কা প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং দিনেশ চান্দিমাল (২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির পর প্রত্যাবর্তন) এবং কামিন্দু মেন্ডিসকে (তার অ্যাম্বিডেক্সট্রাস স্পিনের জন্য) আভিষ্কা ফার্নান্দো এবং চামিকা করুনারত্নের পরিবর্তে দলে নেয়। বাংলাদেশ মেহেদী হাসান মিরাজ এবং মোহাম্মদ সাইফুদ্দিনের পরিবর্তে মাহেদী হাসান এবং তানজিম হাসান সাকিবকে দলে নেয়।
ইএসপিএনক্রিকইনফোর লাইভ কভারেজ অনুসারে, বাংলাদেশ তানজিদ হাসানের অপরাজিত ৭৩ (৪৭ বল) এবং তৌহিদ হৃদয়ের ২৭* রানের সুবাদে শ্রীলঙ্কার দেওয়া টার্গেট সহজে তাড়া করে। মাহিশ থিকশানার ০/৩০ বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের আধিপত্য প্রতিফলিত করে। ম্যাচের ধারাভাষ্যে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মাঠে কঠিন বলে মনে হওয়া পরিস্থিতিতে দুর্দান্তভাবে টার্গেট তাড়া করে, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তাদের প্রথম টি২০আই সিরিজ জয় (২-১) নিশ্চিত করে। উৎসাহী লঙ্কান দর্শকদের উপস্থিতি এবং বাদ্যযন্ত্রের সাথে তাদের সমর্থন ম্যাচের পরিবেশকে আরও উৎসবমুখর করে।
গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়:
- বাংলাদেশ: তানজিদ হাসান (৭৩* রান, ৪৭ বল) ম্যাচ নির্ধারক ইনিংসের জন্য।
- শ্রীলঙ্কা: টার্গেট রক্ষায় ব্যর্থ, বোলাররা আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি।
বিশ্লেষণ এবং গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা
- বাংলাদেশের স্থিতিস্থাপকতা: টেস্ট (১-০) এবং ওডিআই (২-১) সিরিজে হারলেও, টি২০আই সিরিজ জয় বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক অর্জন। তানজিদ হাসান, তৌহিদ হৃদয় এবং শামীম হোসেনের মতো তরুণ খেলোয়াড়রা দলের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। লিটন দাসের টি২০আই-এ ফর্মে ফেরা (দ্বিতীয় টি২০আই-এ ৭৬) দলের জন্য বড় সাফল্য।
- শ্রীলঙ্কার ঘরের মাঠে আধিপত্য: শ্রীলঙ্কা টেস্ট এবং ওডিআই-এ কুশল মেন্ডিস, পাথুম নিসাঙ্কা এবং চারিথ আসালাঙ্কার ব্যাটিংয়ে আধিপত্য দেখায়। তবে দ্বিতীয় টি২০আই-এ তাদের ব্যাটিং ধস (৯৪ রানে অলআউট) মিডল অর্ডারের দুর্বলতা প্রকাশ করে।
- পিচ এবং কন্ডিশন: আর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামের পিচ তৃতীয় টি২০আই-এ দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ের জন্য উপযোগী ছিল, গত দশটি রাতের টি২০আই-এর মধ্যে নয়টি দ্বিতীয় ব্যাটিং দল জিতেছে। প্রথম ইনিংসের গড় স্কোর ছিল ১২৫, যা বোলারদের জন্য সুবিধাজনক ছিল, তবে বাংলাদেশের তাড়া ছিল নিখুঁত।
- খেলোয়াড় উন্নয়ন: বাংলাদেশের দলগত পদ্ধতির উপর জোর দেওয়া ফল দিয়েছে, বিশেষ করে টি২০আই-এ। শ্রীলঙ্কা ২০২৬ টি২০ বিশ্বকাপের জন্য চামিকা করুনারত্নে এবং কামিন্দু মেন্ডিসের মতো খেলোয়াড়দের পরীক্ষা করে।
২০২৫ সালের বাংলাদেশ বনাম শ্রীলঙ্কা সিরিজ ছিল দুই দলের ভিন্ন পর্যায়ের ক্রিকেট যাত্রার প্রতিফলন। শ্রীলঙ্কা তাদের অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের নিয়ে দীর্ঘ ফরম্যাটে আধিপত্য দেখায়, অন্যদিকে বাংলাদেশের তরুণ শক্তি এবং কৌশলগত অভিযোজন টি২০আই-এ উজ্জ্বল হয়। কলম্বোতে তৃতীয় টি২০আই-এর জয় বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যা শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তাদের প্রথম টি২০আই সিরিজ জয়ের অপেক্ষার অবসান ঘটায়। দুই দলই ২০২৬ টি২০ বিশ্বকাপের প্রস্তুতির জন্য এই সিরিজ থেকে মূল্যবান শিক্ষা নেবে, যা আংশিকভাবে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত হবে।
এই সিরিজ বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রতিযোগিতামূলক চরিত্রকে তুলে ধরেছে, যেখানে উৎকর্ষ, হতাশা এবং পুনরুদ্ধারের মুহূর্ত ছিল। ভক্তরা এই দুই দলের পরবর্তী সাক্ষাতে আরও রোমাঞ্চকর লড়াইয়ের অপেক্ষায় থাকবে।